ভারতের ডায়েরীঃ সিলেটের ছাতক থেকে দেশবিভাগের কারণে উড়িষ্যা যাওয়া এক বাঙালির কথা

(ভারতের রাজধানী দিল্লীতে অনুষ্ঠিত বিশ্ব তরুণ সম্মেলনে যোগ দিতে সেখানে গিয়েছেন জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের সাংবাদিকতা ও গণমাধ্যম অধ্যায়ন বিভাগের শিক্ষার্থী নাহিদ ইমরান শাওন । সেখানে অবস্থানকালে তার অনুভূতিগুলো “ভারতের ডায়েরী” নামে শুধুমাত্র প্রাচ্যনিউজে লিখছেন নাহিদ ইমরান।)
এয়ারপোর্টেও মানুষের সমাগম চোখে পড়ার মত না। গতকাল শহরের শপিংমলগুলোতে কেনাকাটার কোন ভীড় দেখিনি। ভীড় ছিলনা যানবাহনেও। যা বুঝলাম তাতে আমার মুদ্রা সমস্যার সমাধান না হলেও স্বস্তি পেলাম। কারণ ভারতীয়দের কাছেই নতুন মুদ্রা নেই। ব্যাংক নতুন মুদ্রা চালু করেছে, দিনে চার হাজারের বেশি কেউ নিতে পারবে না। ফলে ভীড় লেগেছে ব্যাংকে, লোক কমেছে শহরে-বন্দরে। সারি সারি সাজানো চেয়ার। কোন কিছু না ভেবে কেদারায় শরীর এলিয়ে দিলাম। মিনিট বিশেক পর শান্তি নিয়েই ঘুম ভাঙল। সাথে যা আছে এই দুর্দিনে তাই মূল্যবান। বেশি ঘুমালে জিনিসপত্র খোয়া যেতে পারে।
সন্ধ্যা পেরিয়ে রাত প্রায়। একা একা আর ভাল লাগছে না। নিজের একাকিত্ত্ব অনুভব করে মনপুরা ছবির নায়কের কথা মনে পড়ল। তার তো কথা বলার মত মানুষ ছিল নেই। এখানে মানুষ থেকেও কথা বলতে চাওয়ার কোন কারণ খুঁজে পেলাম না। বসে আছি, একজন হিন্দিতে জানতে চাইলো “টেলিভিশনছে সাউন্ড নেহি কিয়া?”। “আই ডোন্ট নো, সরি” । আমার দিকে তাকিয়ে থাকলো লোকটা। মাঝারি গড়নের শরীর সুটেট বুটেড, মাথার চুলগুলো প্রায় সাদা হয়ে যাবে যাবে ভাব। তারপর কি যেন ভেবে বলল, “তোমার বাসা কি কলকাতায়”? থমকে যাওয়ার মত কিছু ছিল না, কারন লোকটা দেখতে বাঙালীদের মত। বাংলায় কথা শুনে আমিও আগ্রহ দেখালাম। সারাটা দিনই তেমন কথা বলা হয়নি। সাধারন আলাপচারিতা করতে পারা যাবে।
নো, আই এম ফরম বাংলাদেশ এন্ড গোয়িং টু দিল্লী। লোকটা আমাকে জড়িয়ে ধরতে পারলে বাঁচে এমন অবস্থা। আবেগে তার কন্ঠ ভারী হয়ে আসল। হাত চেপে ধরে বলতে লাগল। দেশ বিভাগের সময় তারা উড়িষ্যা চলে গেছে। সিলেটের ছাতকে তাঁদের পূর্বপুরুষের ভিটে। তারঁ গল্প আর শেষ হয়না। বাঙালিরা কেমন আছে, দেশের বর্তমান অবস্থা কেমন, সিলেটে কখনো গেছি কিনা, পরের বার গেলে যেন অবশ্যই তাদের বাসা দেখে আসি ইত্যাদি।
মানুষ কতভাবে প্রতারিত হতে পারে তার রকমভেদ নেই। আমি কথা বাড়াতে চাচ্ছিলাম না। আবার না করতেও পারছিলাম না। পড়লাম দোটানায়। আমার কথা শুনতে চাইলেন। বললাম বিস্তারিত। শুনে যেন, আমার সমস্যা সমাধান করা তার একমাত্র কাজে পরিণত হল। এটিএম থেকে টাকা উঠাতে গেল, স্টক শেষ। আমি তার কাজে বিব্রত হচ্ছিলাম। এভাবে কেউ আমাকে সাহায্য করুক তা আমি কখোনোই চাইনা। কিন্তু মানুষটাকে কেন যেন না করতে পারছিলাম না।
টাকার সমাধান হবে না, হবে না, হবে না, না হোক। উহ্, বিরক্তির একটা সীমা থাকে। চুপ করে বসে থাকলাম। মানুষটা রেডিওর মত কথা বলেই চলেছে। মাঝে মাঝে তাঁর কথায় হা হু করতে লাগলাম। তিনি একসময় জানতে চাইলেন রাতে কি খাবো। এই কথার উত্তর দেওয়ার মত কিছু ছিল না, কারন আমার কাছে আছে আর তিনশ টাকার মত। এক কাপ কফির দাম ১০০ টাকা। সো পানি খাওয়া ছাড়া রাতের খাবারে আর কিছু থাকবে না। লোকটা তাঁর ব্যাগ থেকে দুটো স্যান্ডউইস, একটা সস আর এক প্যাকেট বিস্কুট বের করল। আমি ধন্যবাদ দিয়ে না করে দেবো এমন সময় তিনি বুলি আওড়ালেন, দিল্লী থেকে টেনে আনা খাবারগুলো তোমার ভাগ্যেই আছে। আর ভগবান আমাকে তোমার জন্য খাবার নিয়ে পাঠিয়েছেন। আমি পড়লাম মহা বিপদে। খাবার তো খাবই না। মরে গেলেও না। কিন্তু তাকে না করি কিভাবে! তিনি একটা স্যান্ডউইস আমাকে দিলেন আরেকটা নিজে খাওয়া শুরু করলেন। আমি ঠোঁট দুটো প্রসারিত করে বললাম, এখন খিদে নেই, আঙ্কেল। আমি রেখে দিচ্ছি পরে খাবো।
আরে খাবার সামনে দেরি করতে নেই। খাও খাও। আমি রেখে দিলাম, বিস্কিটের প্যাকেট থেকে কয়েকটা বিস্কিট নিয়ে গালের মধ্যে চালান করে দিলাম। রাত বাড়তে লাগল, কথায় কথায় নানা কথা উঠে আসল। তিনি একটা প্রতিষ্ঠানের অফিসার্স এসোসিয়েসনের চেয়ারম্যান। সারা বছরই বিভিন্ন প্রদেশে তাঁর কাজ করতে হয়। সাদামাটা জীবন দেখে বোঝার উপায় নেই। ভারতে বসবাসের প্রাথমিক জীবন, দেশ ছেড়ে আসার ঘটনা, বর্তামনে ভারতের অবস্থা, বাংলাদেশ নিয়েও নানা ভাবনার কথা বললেন।

আমি শুনলাম, বললাম, সব সন্দেহ দূর করে তাকে বিশ্বাস করলাম। তাঁর ভালবাসায় আর স্নেহে চিত্ত ভরে গেল। ৪৭ এ দেশ ছাড়া একটা মানুষ বাংলাদেশ নিয়ে যত ভাবে, দেশের মানুষ যদি তার দশ ভাগও ভাবতো!
সকাল হল। তিনি নিজের শহর উড়িষ্যা যাবেন, আমি দিল্লী। যাওয়ার সময় আমাকে তিনি জোর করেই দুইশো ইন্ডিয়ান রুপি ধরিয়ে দিলেন। তাঁর কাছেও নতুন টাকা বেশি ছিলনা। বুঝলাম এটিএম থেকে টাকা না উঠায় আমার ঋণের বোঝা কম হয়েছে।
(চলবে…)

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *