প্রথম জীবনঃ
ছবির এই মেয়েটির নাম রহিমা। তার পিতার নাম আক্কেল আলী। গ্রাম পিরোজপুর। বর্তমান নিবাস একটি রিকসা-ভ্যান। চলাচলঃ সারা ঢাকা শহর। পেশাঃ রিকসা-ভ্যান চালানো।
একটি যুবতী বয়সের মেয়ে ঢাকা শহরে রিকসা-ভ্যান চালিয়ে জীবিকা নির্বাহ করে; ভাবা যায়? অথচ এই মেয়েটি সেটাই করে পেট চালায়। শুধু নিজের পেট নয়- তার বাবাকেও সঙ্গে টানে এবং তার বাবার জীবনও মেয়েটির আয়-রোজগারের ওপরেই চলে! ভোরে ঘুম থেকে ওঠেই শুরু হয় মেয়েটির সংগ্রাম। এখানে ওখানে রিকসা-ভ্যান দিয়ে মালামাল টেনে দু’বেলা খাবারের পয়সা যোগায়। কিন্তু একটি যুবতী বয়সের মেয়ে ঢাকায় রিকসা-ভ্যান চালিয়ে জীবিকা নির্বাহ করে এটা একটি বিস্ময়ের বিষয় বটে। একেতো ‘পুরুষ-নিয়ন্ত্রিত’ সমাজ। মেয়েটির জন্য এখানে ওখানে ওঁৎ পেতে আছে নানান দুর্যোগ দূর্বিপাক। পান থেকে চুন খসলেই সব শেষ।
তার ওপরে প্রচন্ড ‘প্রতিযোগিতার বাজার’। এই বাজারে শারীরিকভাবে শক্তিশালী পুরুষ ভ্যান-চালকেরাই হালে পানি পায় না, সেখানে আবার নারী! প্রচন্ড লড়াই সংগ্রামের মধ্য দিয়ে টিকে আছে এই যুবতী। প্রথমে নিজেকে বাঁচাতে হয় নানাভাবে, তারপরে আসে সংগ্রাম। আমাদের সমাজে নারী হয়ে জন্মানোটাই বোধহয় একটি বিড়ম্বনা!
‘আইয়ামে জাহেলিয়াতে’ নাকি আরবদেশে মেয়ে-নবজাতকদের জীবন্ত পুঁতে ফেলা হত! ভাগ্যিস, আমাদের এখনো সেই অবস্থায় পড়তে হয় নি! কিন্তু প্রতি নিয়ত গোপনে কিংবা প্রকাশ্যে আমাদের হাতে অর্থাৎ পুরুষের হাতে নারীরা যে পরিমানে নির্যাতিত হয়; সেটার সঠিক তথ্য যদি সত্যিই প্রকাশিত হত- তাহলে অবস্থা কি দাঁড়াতো!মেয়েটিকে জিজ্ঞেস করলাম- রিকসা-ভ্যান না চালিয়ে কোন বাসা বাড়িতে কাজ করলেই তো পারেন। কিংবা কোন অফিসে? ওখানে কি আপনার জন্যে কোন কাজ নেই? মেয়েটির উত্তরঃ বাড়ির সাহেবরা খালাম্মা বাসায় না থাকলে যা করেন আমাদের সাথে, তাতে এই রিকসা-ভ্যান চালাইয়া পেট চালান’ডা অনেক ভালা! তাছাড়া এক অফিসে কাম নিছিলাম ‘পিওনের’! ওই অফিসে পিওনের কামের চাইতে সাহেবের ………… করতে হয় অনেক বেশী। শেষমেশ এই রিকসা-ভ্যান ধরছি। স্বাধীন কাম। যতক্ষণ কাম ততক্ষণ টাকা। ওই টাকা দিয়া নিজে চলি আমার অসুখ্যা বাপরে চালাই!
শ্রদ্ধার মাথাটা নুয়ে আসলো মেয়েটার প্রতি। পাশাপাশি, পুরুষতান্ত্রিক সমাজে নিজেকে পুরুষের জায়গায় রেখে মেয়েটার কাছে নিজেকে খুব ছোট মনে হল! এখানে লেখাটি সমাপ্ত করতে পারলে খুশী হতাম।
না, ‘কাহিনী’ কিন্তু আরো আছে। আসলে ওপরের কাহিনীর ‘পুরুষ-সংক্রান্ত’ চ্যাপ্টারটি হল আমার কল্পনা, আমার প্রত্যাশা। মেয়েটি সত্যিই ‘ওরকম’ একটি ‘আত্ম-মর্যাদাসম্পন্ন’ দৃঢ, শক্তিশালী একটি অবস্থানে গিয়ে সমাজে লড়াই করতে নামলে আমি খুব খুশী হতে পারতাম। কিন্তু বিষয়টি আসলে সে রকম নয় মোটেই!
এবার আসল কাহিনীটি বলছি আপনাদের জন্য-
দ্বিতীয় জীবনঃ
মেয়েটির নাম আসলে রহিমা নয়। তার বাপের নামও আক্কেল আলী নয়। পিরোজপুরেও তাদের বাড়ি নয়। তাদের আসল পরিচয়টি সঙ্গত কারনেই গোপন রাখা হল। সেদিন বাংলা একাডেমির বই মেলা শেষে আলিয়ঁসে কিছুক্ষণ আড্ডা দিয়ে বাসায় ফিরছিলাম রিকশায় করে। ধানমন্ডি রাশান কালচারাল সেন্টারের কাছে আসতে হঠাৎ নজরে পড়লো রাস্তায় রিকসা-ভ্যানে মশারি টানিয়ে এক লোক মোবাইল ফোনে কথা বলছেন বেশ খোশ মেজাজে। বিষয়টি একটু ভিন্নরকম মনে হতেই রিকশা থেকে নেমেই ছবিও তুলতে শুরু করি।
আমার ছবি তোলা দেখে এই মেয়েটি এগিয়ে এলো। আমি জিজ্ঞেস করি রিকসা-ভ্যানের ভেতরে মানুষটি কে? মেয়েটির উত্তরঃ আমার বাবা। প্রশ্নঃ আপনি কি করেন? উত্তরঃ এই রিকসা-ভ্যান’টি চালাই। বাহ, আমি তো হাতে চাঁদ পেয়ে যাই। এই বুঝি লেখার জন্য অসাধারণ একটি বিষয় পেয়ে গেলাম। সেকেন্ডের মধ্যেই মনে মনে একটি গল্প বানিয়ে ফেলি; যেটা ‘প্রথম জীবন’ চ্যাপ্টারে উল্লেখ করেছি ওপরে।
যেহেতু মেয়েটি রিকসা-ভ্যান চালায়, সেহেতু তাকে নিয়ে কিছু লিখতে গেলেই এই রিকসা-ভ্যানসহ মেয়েটির ছবি নিশ্চই প্রয়োজন হবে! সেই আন্দাজে রিকসা-ভ্যানের সাথে মেয়েটিকে দাঁড় করিয়ে বেশ ক’টি ছবি তুলে নেই। আমি ছবি তুলছি দেখে পাশে দাঁড়ানো এক মহিলা মেয়েটিকে ছবির জন্য কিভাবে ‘পোজ়’ দিতে হবে তার একটি ধারা বর্ণনা দিতে থাকে! মেয়েটিও সে অনুযায়ী পোজ দিয়ে যায়।
তার বাবার সাথে কথা বলতে চাইতেই মশারি তুলে শোয়া অবস্থাতেই তিনি কথা বললেন। আমি আবার যে কোন exclusive interview ভিডিওতে ধারণ করে রাখি। প্রথমত, পরে সেটা যে কোন ‘আপদে বিপদে’ কাজে লাগে। দ্বিতীয়ত- আমার আর্কাইভের জন্য document হিসেবেও এটার একটি মূল্য হয়ে যায়। সে কারনে মোবাইল ফোনের ভিডিও option-এ গিয়ে on record-এ আমি মেয়েটির সাথে কথা বলতে শুরু করি।
প্রশ্নঃ আপনার নাম কি?
উত্তরঃ ………………
প্রশ্নঃ কি করেন আপনি?
উত্তরঃ এই রিকসা-ভ্যান’টি চালাই!
প্রশ্নঃ ডেইলি কত আয় হয়?
উত্তরঃ ঠিক নাই। মানুষজন যেদিন যা দেয়!
প্রশ্নঃ মানে……?
উত্তরঃ মানে আমার বাবা তো অসুস্থ, সে জন্য লোকের কাছে হাত পাতি। লোকে যা দেয় সেইটা দিয়া দু’জনে খাই!
এরপরে আমি কিছুক্ষণ নিরব থাকি! প্রচন্ড ঝড় বইতে থাকে মগজে। অনেকগুলো প্রশ্ন এসে ভীড় করে চিন্তায়। হিসাব মেলে না! মনে মনে ভাবতে থাকি, শক্ত-সমর্থ এই মেয়েটি কোন অফিস কিংবা বাসায় কাজ করেনা কেন? কেন অন্য কোন ‘সমাজ-সিদ্ধ’ পেশায় যুক্ত হয় না। তার বাবাটিই বা কেমন! তার সোমত্ত মেয়েটিকে দিয়ে ভিক্ষা (জানিনা শব্দটি যথাযথ হল কী না) করাচ্ছে। পিতা হয়ে তার আত্মসম্মানে কি একটুও লাগছে না? হোক অসুস্থ, তাই বলে মেয়েকে দিয়ে মানুষের কাছে হাত পাতা? কেন, কেন?
আমার এই প্রশ্নগুলো ‘ওদের দু’জনকে’ই করেছিলাম। যা উত্তর পেয়েছি সেগুলো শুনলে আরো মন খারাপ হয়ে যাবে সবার। থাক। হে সৃষ্টিকর্তা, তুমি মানুষকে সুমতি দাও! কারো কারো আত্মসম্মানবোধটি আরো চাঙ্গা করে তোল। অসুস্থ মানুষকে সুস্থ করে দাও। আমাদের সবাইকে আরো বেশী বেশী মানবিক আর যুক্তিবান করে তোল!
লেখকঃ অভিনেতা ও নির্মাতা
আর্টিকেলটি নিয়ে মন্তব্য করুন