নরেন্দ্র মোদী হিন্দুত্ববাদের ঘাড়ে বন্দুক রেখে ২০১৪ সালে ক্ষমতায় আসার পর এই প্রথম রাষ্ট্রীয় সফরে মাননীয় প্রধানমন্ত্রী জননেত্রী শেখ হাসিনা আজ ভারতে গেছেন। ভারতের গণমাধ্যম, বিভিন্ন থিঙ্কট্যাঙ্ক এ সফরকে ঐতিহাসিক সফর বলে অভিহিত করছেন। তাঁর কারণ ভারতের কাঙ্খিত প্রতিরক্ষাবিষয়ক সমঝোতা স্মারক সই হবে দুই দেশের মধ্যে, যা পাঁচ বছর মেয়াদের। তবে পাঁচ বছর পরপর সয়ংক্রিয়ভাবে সময় বৃদ্ধি হয়ে যাবে।
মূলত চীনের কাছ থেকে বাংলাদেশ দুটো সাবমেরিন ক্রয় করার পর থেকেই ভারত নড়েচড়ে বসে। এটাকে ভারতীয় বিশ্লেষকরা চীন কর্তৃক ভারতকে ঘিরে ফেলার কৌশল হিসেবে দেখতে শুরু করে। ভারতীয় প্রতিরক্ষামন্ত্রী মনোহর পারিকর বাংলাদেশে এসে প্রতিরক্ষা চুক্তি করার দাবি পেশ করেন। তাঁর পরিপ্রেক্ষিতেই প্রতিরক্ষাবিষয়ক সমঝোতা স্মারক সই হতে যাচ্ছে। কিন্তু কথা হচ্ছে, এ সমঝোতা স্মারক বাংলাদেশের জন্য কতটা জরুরি? বাংলাদেশ কি আদৌ লাভবান হবে?
ভারত ৫০ কোটি ডলার দিচ্ছে এ সমঝোতার আওতায়, যে অর্থ দিয়ে ভারত থেকেই অস্ত্রশস্ত্র আমদানি করতে হবে। ভারত নিজেই পৃথিবীর মধ্যে প্রধান অস্ত্র আমদানিকারক দেশ। ভারতের অস্ত্রশস্ত্রের মান নিয়েও রয়েছে নানা প্রশ্ন। আবার আমাদের স্বাধীনতার পর থেকে চীনের তৈরি অস্ত্রশস্ত্র ও সামরিক সরঞ্জাম ব্যবহার করে আসছে আমাদের সামরিক বাহিনী। অর্থাৎ চীনের তৈরি সরঞ্জামে আমাদের সামরিক বাহিনী বেশি স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করে থাকে। এখন যদি ভারত থেকে আমদানিকৃত অস্ত্র, সামরিক সরাঞ্জম সামরিক বাহিনীকে দেওয়া হয় তাহলে খাপ খাওয়াতে অনেক সমস্যা হবে। ভারতের সাথে এই সামরিক সম্পর্ককে চীন কীভাবে দেখবে? তাঁরা কি বিষয়টিকে স্বাভাবিক ভাবে দেখবে?
চীন আমাদের দেশের বড় মিত্রদেশ। চীনা প্রেসিডেন্ট শি চিন পিং এর গেল বছরের বাংলাদেশ সফর দু’দেশের সম্পর্ককে আরো উচ্চস্তরে নিয়ে গেছে। প্রায় ৩০ বিলিয়ন ডলার বিনিয়োগ করার প্রতিশ্রুতি দিয়েছে চীনা প্রেসিডেন্ট। চীনা সামরিক সরঞ্জাম ছাড়া বাংলাদেশের সামরিক বাহিনীকে কল্পনা করা যায় না। তাই তাঁদেরকে আস্থায় আনাটা সবচেয়ে বেশি জরুরি। তাঁদেরকে বুঝাতে হবে যে, ভারতের সাথে শুধুই মাত্র সমঝোতা স্মারক সাক্ষরিত হচ্ছে। এর বেশি কিছু নয়। আমাদের তিন দিক ঘিরে রেখেছে বৃহৎ রাষ্ট্র ভারত। আমাদের স্বার্থের সংঘাত আছে সবচেয়ে বেশি ভারতের সাথেই। তিস্তাসহ অভিন্ন ৫৪ টি নদীর পানির ন্যায্য হিস্যা, সিমান্তে নির্বিচরে বিএসএফ কর্তৃক নিরীহ নিরপরাধ বাংলাদেশি হত্যা ইত্যাদি বিষয় নিয়ে বাংলাদেশের মানুষের মনে ক্ষোভ আছে। কাজেই ভবিষ্যতে কোন রাষ্ট্রের সাথে যদি বাংলাদেশের যুদ্ধাবস্থার তৈরি হয় তাহলে হবে ভারত এবং মায়ানমারের সাথে। সুতরাং ভূ-রাজনৈতিক এসব বিষয় বিবেচনাপূর্বক চীনের সাথে সম্পর্ক উন্নয়নের কোন বিকল্প নেই। প্রতিরক্ষা চুক্তি এবং তিস্তা নিয়ে আলোচনার ডামাডোলে অতি গুরুত্বপূর্ণ দুটি বিষয় আলোচনার বাইরে রয়ে গেছে।
বাংলাদেশের মূলধারার মিডিয়ার কাছে প্রত্যাশা থাকলেও তাঁরা বিষয়টিকে কেন জানি এড়িয়ে গেছে। সে দুটি বিষয় হল — ১. সীমান্ত হত্যা ২. বাংলাদেশের মিডিয়ার ভারতে প্রবেশাধিকার। পৃথিবীর সবচেয়ে ভয়ংকর সীমান্ত বাংলাদেশ- ভারত সীমান্তকে বললে অত্যুক্তি হয় না। প্রতিনিয়ত নিরীহ বাংলাদেশীকে নির্মমভাবে হত্যা করে বর্বরতার পরিচয় দেয় কুখ্যাত ভারতীয় সীমান্তরক্ষী বাহিনী বিএসএফ। সীমান্তে এধরণের হত্যাকান্ড জারি রেখে কখনোই বাংলাদেশের সঙ্গে বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক বজায় রাখা সম্ভব নয়। ভারত যাদেরকে শত্রু রাষ্ট্র বলে দাবি করে সেই পাকিস্তান সীমান্তেও তো বিএসএফের দ্বারা এত পাকিস্তানি হতাহতের ঘটনা ঘটে না! তাহলে প্রশ্ন ওঠে, এ কেমন বন্ধুত্বের নিদর্শন? আশা করি, প্রধানমন্ত্রী জননেত্রী শেখ হাসিনা সীমান্ত হত্যার বিষয়টি গুরুত্বের সঙ্গে তুলে ধরবেন। ভারতের টিভি চ্যানেলগুলো বাংলাদেশে অবাধে চললেও বাংলাদেশের টিভি চ্যানেলের কোন প্রবেশাধিকার এখন পর্যন্ত ভারতে নেই। যা অত্যন্ত পরিতাপের বিষয়। ভারতীয় চ্যানেলগুলোর বিভিন্ন কুরুচিপূর্ণ সিরিয়ালগুলোর মারাত্মক প্রভাব আমাদের সমাজে পড়ছে। যাঁর ফলে পরকীয়া, ডিভোর্স, আত্মহত্যা ইত্যাদির মতো সামাজিক ব্যাধি ক্রমশ আমাদের সমাজকে জেঁকে ধরছে। তাই এখানে ফিল্টারিং ব্যবস্থা থাকতে হবে। শুধুমাত্র ভালো মানের অনুষ্ঠানগুলোই চলতে পারবে।
মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার কাছে অনুরোধ, তিনি যেন বাংলাদেশী চ্যানেল ভারতে চলার ব্যাপারে শক্ত অবস্থান নিয়ে ভারতের সাথে আলোচনার সূত্রপাত করেন। একতরফাভাবে শুধু ভারতকে দিয়ে যাব বিনিময়ে কিছু পাব না তা তো হতে পারে না। যেমনটি আমাদের মাননীয় প্রধানমন্ত্রী দ্য হিন্দু পত্রিকায় প্রকাশিত তাঁর এক নিবন্ধে বলেছেন যে, ” দেওয়া এবং নেওয়ার নামই হল বন্ধুত্ব “। আমরা আমাদের প্রিয় প্রধানমন্ত্রীর সংজ্ঞায়িত বন্ধত্ত্বে বিশ্বাসী।
লেখক: শিক্ষার্থী, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়
আর্টিকেলটি নিয়ে মন্তব্য করুন