শেখ আদনান ফাহাদঃ
এ যেন মহোৎসব। মহান মুক্তিযুদ্ধের চেতনার গণজাগরণ ঘটানোর প্রয়াসে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ব বিদ্যালয়ের প্রশাসন ২৫ মার্চ থেকে শুরু করতে যাচ্ছে সাত দিনব্যাপী ‘মুক্তি সংগ্রাম নাট্যোৎসব’। নাটকসমূহকে কেন্দ্র করে ৩১ মার্চ পর্যন্ত একের পর এক আয়োজিত হবে আলোচনা সভা, গান, আবৃত্তি, আর্ট ক্যাম্প, মুক্তিযুদ্ধের স্মারক প্রদর্শনীসহ যাবতীয় সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ড।
পুরো বাংলাদেশ, বিশেষ করে নতুন প্রজন্ম মুখিয়ে আছে দেশের সাংস্কৃতিক রাজধানী জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাসে অনন্য এই সাত দিনের নাটক, সঙ্গীতের সমারোহে হারিয়ে গিয়ে নিজেকে পূর্ণ চেতনা ও হুশে আবার ফিরে পেতে। বাংলাদেশের বহু ঐতিহাসিক নাটক আর সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের ভেন্যু সেলিম আল দীন মুক্তমঞ্চে সাত দিনের উৎসব দিয়ে যুগ যুগ ধরে প্রজন্মের ভেতরে দেশপ্রেমের চেতনা জাগাতে চান আয়োজকরা।
রাষ্ট্রীয় সিদ্ধান্তে ২৫শে মার্চকে গণহত্যা দিবস হিসেবে পালন করছে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়। সভ্যতার ইতিহাসের বর্বরতম গণহত্যার বিচার একদিন হবে। পাকিস্তান সেনাবাহিনীকে মানবতাবিরোধী অপরাধের জন্য একদিন তাদের স্থানীয় দোসরদের মতো আদালতের কাঠগড়ায় দাঁড়াতে হবে। গণহত্যার দায়ে একদিন এদেরও বিচার হবে। জাতির এই চির আকাঙ্ক্ষিত সময়কে প্রলম্বিত হতে দিতে চায় না জাহাঙ্গীরনগর পরিবার। আর তাইতো সাত দিনের কর্মসূচির শুরু হিসেবে বেছে নেওয়া হয়েছে এই দুঃখজনক, বেদনাদায়ক তারিখটিকে। ২৫শে মার্চ, ১৯৭১। এদিন রাতে নিরীহ ঢাকাবাসীর ওপর ঝাঁপিয়ে পড়েছিল পাকিস্তানী সেনাবাহিনী। মেতে উঠেছিল গণহত্যার পৈশাচিকতায়। মুক্তিযুদ্ধের নয় মাসে এক হাজার নয়, এক লাখ নয়, ৩০ লাখ মানুষ হত্যা করেছিল পাকিস্তানী সেনাবাহিনী এবং তাদের স্থানীয় দোসররা। দুই লাখ নারীকে সইতে হয়েছে অবর্ণনীয় নির্যাতন। একুশ শতকে জাতির অন্যতম কাণ্ডারি হয়ে জাহাঙ্গীরনগর ২৫শে মার্চ বিকাল থেকেই শুরু করবে চেতনা জাগানিয়া সপ্তাহব্যাপী কর্মযজ্ঞ।
বিকাল চারটা ৩৫মিনিটে জাতীয় সঙ্গীতের সাথে জাতীয় পতাকার উত্তোলনের মধ্য দিয়ে শুরু হবে সাংস্কৃতিক রাজধানীর এই সাত দিনের রণযাত্রা। উদ্বোধন করবেন বীর মুক্তিযোদ্ধা তারামন বিবি, বীরপ্রতীক। সাথে থাকবেন জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক ড. ফারজানা ইসলাম। অধ্যাপক ফারজানা ইসলাম ইতোমধ্যেই বাংলাদেশের ইতিহাসের প্রথম নারী উপাচার্য হিসেবে স্থিতিশীল প্রগতির স্বাক্ষর রেখেছেন সাংস্কৃতিক রাজধানীর সবুজ ক্যাম্পাসে।
প্রথম দিনের কর্মসূচির অন্যতম আকর্ষণ হবে মুক্তিযুদ্ধের স্মারক পরিচিতির বুথ উন্মোচন। এর আয়োজনে থাকবে সরকারের প্রত্নতত্ত্ব বিভাগ ও বাংলাদেশ ডাক বিভাগ। দিনটিকে আরও বর্ণিল ও স্মরণীয় করে রাখতে জাহাঙ্গীরনগরের চারুকলা বিভাগের শিক্ষক-শিক্ষার্থীরা মিলে আয়োজন করছে মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক আর্ট ক্যাম্প প্রদর্শনী।
দিনের দ্বিতীয় অধিবেশনে বিকাল সাড়ে পাঁচটায় মুক্তি সংগ্রামে শহীদদের প্রতি শ্রদ্ধা জানিয়ে এক মিনিট নীরবতা পালন করা হবে। হৃদয়কাড়া সূচনা সঙ্গীতের সাথে থাকবে মঙ্গল মশাল প্রজ্বলন। শুভেচ্ছা বক্তব্য দেবেন ছাত্র-শিক্ষক কেন্দ্রের পরিচালক অধ্যাপক বশির আহমেদ। অধিবেশনে বাংলাদেশের মুক্তি সংগ্রাম ও নাট্য আন্দোলন নিয়ে বক্তব্য দেবেন অধ্যাপক এ কে এম ইউসুফ হাসান, নাট্য ব্যক্তিত্ব মামুনুর রশীদ, রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব ড. মহীউদ্দীন খান আলমগীর, বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক ও সাবেক পররাষ্ট্রমন্ত্রী ডা. দীপু মনি এমপি, সরকারি কর্ম কমিশনের সদস্য ও সাবেক জাবি উপাচার্য অধ্যাপক ড. শরীফ এনামুল কবির, বিকন ফার্মাসিউটিক্যালের ব্যবস্থাপনা পরিচালক এবাদুল করিম বুলবুল।
প্রধান অতিথি হিসেবে প্রথম দিনের অনুষ্ঠানে বক্তব্য দেবেন জাতীয় সংসদের স্পিকার ড. শিরিন শারমিন চৌধুরী। সভাপতিত্ব করবেন বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক ড. ফারজানা ইসলাম।
তবে রাতের মূল আকর্ষণ হবে বাংলাদেশের গুণী ব্যক্তিত্বদের স্মারক সম্মাননা প্রদান পর্বটি। অন্যান্যদের মধ্যে মরণোত্তর স্মারক সম্মাননা পাচ্ছেন জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের ছাত্র, উপমহাদেশের কিংবদন্তি অভিনেতা হুমায়ুন ফরিদী। হুমায়ুন ফরিদীকে সম্মাননা দেয়ার বিষয়টি ইতোমধ্যেই ক্যাম্পাসের সর্বমহলে অত্যন্ত সমাদৃত হয়েছে।
এই রাতে আরও যারা স্মারক সম্মাননা পাচ্ছেন তারা হলেন- নাট্য ব্যক্তিত্ব মামুনুর রশীদ, ড. মহীউদ্দীন খান আলমগীর, এবাদুল করিম বুলবুল, ডা. দীপু মনি এমপি, নাট্যাচার্য সেলিম আল দীন (মরণোত্তর), আব্দুল্লাহ আল মামুন ( মরণোত্তর), কবি সৈয়দ শামসুল হক (মরণোত্তর), শহীদ জননী জাহানারা ইমাম (মরণোত্তর), তারামন বিবি বীর প্রতীক এবং স্পিকার শিরীন শারমিন চৌধুরী।
প্রথম দিনের অনুষ্ঠান শেষ হবে পদাতিক নাট্য সংসদ (টিএসসি) এর পরিচালনায় নাটক ‘কালরাত্রি’ মঞ্চায়নের মধ্য দিয়ে।
২৬ মার্চ মহান স্বাধীনতা দিবসে অনুষ্ঠান শুরু হবে এক অভিনব কর্ম সম্পাদনের মধ্যে দিয়ে। রাষ্ট্রপতি আব্দুল হামিদ দেশব্যাপী ৩০ লাখ বৃক্ষ রোপণের উদ্বোধন করবেন। এর সাথে সঙ্গতি রেখে দুপুর তিনটায় জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়েও শুরু হবে বৃক্ষরোপণ। ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটির মুখপাত্র অধ্যাপক শাহরিয়ার কবির অনুষ্ঠানটি পরিচালনা করবেন। বৃক্ষরোপণ শেষে শুরু হবে সেই পর্ব যেখানে স্মারক সম্মাননা (মরণোত্তর) প্রদান করা হবে মুজিবনগর সরকারের প্রধানমন্ত্রী, যিনি বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে পুরো যুদ্ধ সরাসরি পরিচালনা করে আমাদের স্বাধীন রাষ্ট্র উপহার দিয়ে গেছেন, সেই মহান বিপ্লবী তাজউদ্দিন আহমদকে। এছাড়াও ইতিহাসবিদ অধ্যাপক মুনতাসির মামুন, চিত্রশিল্পী হাশেম খান, ভাস্কর জাহানারা পারভীনকেও সম্মাননা স্মারক প্রদান করা হবে।
প্রধান অতিথি হিসেবে উপস্থিত থাকার পাশাপাশি বাবার পক্ষে স্মারক গ্রহণ করবেন তাজউদ্দিন আহমদের মেয়ে সিমিন হোসেন রিমি। তাকেও স্মারক প্রদান করবেন উপাচার্য অধ্যাপক ফারজানা ইসলাম।
এদিন সাংস্কৃতিক পর্ব পরিচালনা করবে সম্মিলিত সাংস্কৃতিক জোট, জাবি, শেখ রাসেল স্মৃতি সংসদ, জাবি এবং জয় বাংলা সাংস্কৃতিক জোট।
২৭ মার্চ তারিখে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে বক্তৃতা ও সম্মাননা স্মারক গ্রহণ করতে উপস্থিত থাকবেন গাজী গোলাম দস্তগীর গাজী এমপি, নাট্যব্যক্তিত্ব আতাউর রহমান, অভিনয় ব্যক্তিত্ব ফেরদৌসী মজুমদার। প্রধান অতিথি হিসেবে অনুষ্ঠানে উপস্থিত থেকে বক্তব্য দেবেন ডাক ও টেলিযোগাযোগ প্রতিমন্ত্রী তারানা হালিম। এছাড়া তিনি সম্মাননা স্মারকও গ্রহণ করবেন।
মঞ্চস্ত হবে নাটক ‘পায়ের আওয়াজ পাওয়া যায়’। পরিবেশনায় থাকবে ঢাকার বেইলি রোডের ‘থিয়েটার’।
২৮ মার্চ থেকে ৩১ শে মার্চ পর্যন্ত জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে বাংলাদেশের বিভিন্ন ক্ষেত্রের গুণী ব্যক্তিত্বরা আসবেন। শিক্ষক, ছাত্র-ছাত্রী, কর্মকর্তা-কর্মচারীদের সামনে নিজেদের অভিজ্ঞতা, চিন্তা, ভাবনা তুলে ধরে জ্ঞান আলোকের বিচ্ছুরণ ঘটাবেন।
অন্যান্যদের মধ্যে আরও উপস্থিত থাকবেন বধ্যভূমির আবিষ্কারক ডা. মো. আবুল হোসেন, সাংবাদিক মনজরুল আহসান বুলবুল, মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রী মুক্তিযোদ্ধা আকম মোজাম্মেল হক, সিআরপির প্রতিষ্ঠাতা ভেলরি এন্ড টেলর, শিল্পকলা একাডেমির মহাপরিচালক লিয়াকত আলী লাকী, নারায়ণগঞ্জের মেয়র সেলিনা হায়াৎ আইভি, বিশিষ্ট নগর পরিকল্পনাবিদ ও ইউজিসির সাবেক চেয়ারম্যান অধ্যাপক নজরুল ইসলাম, ইউজিসির বর্তমান চেয়ারম্যান অধ্যাপক আব্দুল মান্নান, অভিনেতা তারিক আনাম খান, ডাক্তার নুজহাত চৌধুরী, মাহাবুব আরা গিনি এমপি, পিএসসির চেয়ারম্যান ড. মোহাম্মদ সাদিক, প্রধানমন্ত্রীর মুখ্য সচিব ড. আবু নাসের কামাল চৌধুরী, নাট্য ব্যক্তিত্ব সারা যাকের, রামেন্দু মজুমদার, আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক মাহবুব-উল-হানিফ, সংস্কৃতি মন্ত্রী আসাদুজ্জামান নুর এমপি, ও সঙ্গীত ব্যক্তিত্ব এন্ড্রু কিশোর।
শেষের দিন মরণোত্তর সম্মাননা স্মারক প্রদান করা হবে গণমাধ্যম ব্যক্তিত্ব সড়ক দুর্ঘটনায় নিহত মিশুক মুনিরকে। ২৮, ২৯, ৩০ ও ৩১ মার্চ নাটক মঞ্চস্ত হবে যথাক্রমে সময়ের প্রয়োজনে, নটপালা, মৃত্যুপাখি ও জেরা।
জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় পরিবারের পক্ষ থেকে বাংলাদেশ এবং দেশের বাইরের সকল বাঙালি, অবাঙালি দেশপ্রেমিকদের সাংস্কৃতিক রাজধানীতে নেমন্তন রইল। বিশেষ করে নতুন প্রজন্মের বাংলাদেশিদের জন্য এ এক বিরাট বিরল সুযোগ। নিজেকে জানার এবং আবিষ্কার করার সুযোগ সবাইকে দু হাত ভরে নেয়ার অনুরোধ রইল।
লেখক: সহকারী অধ্যাপক, সাংবাদিকতা ও গণমাধ্যম অধ্যয়ন বিভাগ, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়
আর্টিকেলটি নিয়ে মন্তব্য করুন