অরিন্দম নাথঃ
প্রকাশের সাথে আমার দেখা বাংলাদেশের কিশোরগঞ্জে ৷ এখন তার বয়স প্রথম পরিচয়ের দ্বিগুণ ৷ এবারের পরিচিতির কথা শোনাবার আগে প্রথমবারের পরিচিতির কথা শুনাই ৷ সেবার আমার সাথে করমচাঁদ ছিলেন ৷ প্রত্যুষ-বাবু আজ প্রয়াত ৷ তিনি বেঁচে থাকলে হয়তো খুশি হতেন ৷ প্রকাশ সৎ পথে জীবিকা নির্বাহ করছে ৷
আমার তখন বেশ পরিচিতি হয়েছে ৷ একদিন সকালে এক ভদ্রমহিলার ফোন৷ অরুন্ধতী-নগর থেকে ৷ বৃদ্ধা মহিলা ৷ গলার সুরেই বুঝলাম ৷ বললেন, ‘মেঘনাদ-বাবু, আপনি কষ্টকরে একবার আমার বাড়িতে আসতে পারবেন ?’
মহিলার গলায় আভিজাত্যের সুর ৷ মানুষ বিপদে পড়লেই পুলিশের খবর করে ৷ বললাম, ‘এক্ষুনি আসতে হবে?’
– না, আপনি আপনার সময় করে আসুন ৷
– তাহলে আজ সন্ধ্যা ছ-টার দিকে আসছি ৷ আমার সাথে একজন অফিসারও আসবেন ৷
বাড়ির ঠিকানা জেনে নিলাম ৷ কথামত করমচাঁদ সহ গেলাম ভদ্রমহিলার বাড়ি ৷ সাদা পোশাকে ৷ শ্রীনগর মিলনচক্র, অরুন্ধতীনগর ৷ একটি গলির শেষ মাথায় বাড়ি ৷ লোডশেডিং ৷ বাড়ি খুঁজতে একটু কষ্ট হল ৷ আল্পনা দেবরায় ৷ অবসরপ্রাপ্ত শিক্ষিকা ৷ বয়স ষাটের ঘরে ৷ ভদ্রমহিলা আমাদের জন্য অপেক্ষা করছিলেন ৷ সাথে বড়ো ছেলের বন্ধু প্রদীপ রায় ৷ আল্পনা দেবী সধবা ৷ বাড়ির কর্তা চা-বাগানে কাজ করতেন ৷ এখন অবসর জীবন কাটাচ্ছেন ৷ সন্ধে হলেই বেরিয়ে যান ৷ সমবয়সী একদল বুড়োর সাথে তাস খেলতে ৷ আজো অনুপস্থিত ৷ দুই ছেলে অজিত আর সুজিত ৷ দু-জনই বিবাহিত ৷ রাজ্যের বাইরে চাকুরী করে ৷ পূজার সময় পরিবার নিয়ে কিছুদিন থেকে যায় ৷ প্রদীপ-বাবু মাঝে-মধ্যে মেসো-মাসিমাকে দেখে যান ৷ কুঞ্জবন কোয়াটার্সে থাকেন ৷ বয়স ত্রিশের কোঠায় পূর্ত দপ্তরের বাস্তুকার ৷
চা-বিস্কুটের পালা শেষ হলে আল্পনাদেবী শুরু করলেন ৷ ঘটনা গত পরশু দিনের ৷ সন্ধ্যায় আজকের মত লোডশেডিং ৷ আল্পনা দেবী বাড়িতে একা ৷ পেছনের দরজায় তালা লাগিয়ে বেরিয়ে গিয়েছিলেন ৷ পাশের বাড়িতে গল্প করতে ৷ সামনের দরজায় ভেতর থেকে ছিটকানি লাগানো ৷সামনের ঘরে একটি হ্যারিক্যান জ্বালানো ছিল ৷ আল্পনাদেবী বেরিয়ে যাওয়ার পর প্রদীপ-বাবু এসে হাজির ৷ এসে দেখেন সামনের দরজা বন্ধ ৷ ভেতরের ঘরে আলো দেখা যাচ্ছে ৷ প্রদীপ-বাবু মাসিমাকে ডাকলেন ৷ প্রথমে কোনও সাড়া-শব্দ নেই ৷ তারপর ভেতর থেকে আওয়াজ এলো, ‘যাচ্ছি ৷’ পুরুষ-কণ্ঠে ৷একটি ছেলে সামনের দরজা খুলে দিল ৷ হাতে হ্যারিকেন ৷ বয়স উনিশ-কুড়ি ৷ বলল, ‘মাসিমার কাছে এসেছেন?
বলেই প্রদীপ-বাবুর উত্তরের অপেক্ষা না করে বলল, ‘মাসিমা সামনের বাড়িতে গিয়েছেন ৷ আমি ডেকে দিচ্ছি ৷ আপনি বসুন ৷ আলোটা দিয়ে যাচ্ছি ৷’
প্রদীপ-বাবু সামনের ঘরে বসলেন ৷ ছেলেটি ঘরের ভেতরে চলে গেল ৷ বলল পেছনের দরজায় আমার চটি ৷ একটু পরেই সামনের গেট দিয়ে বেরিয়ে গেল ৷ প্রদীপ-বাবু ছেলেটিকে আর দেখেন নি ৷ কথায় খুবই মিষ্টতা ৷ বিশুদ্ধ বাংলায় কথা বলে ৷ ভাবছিলেন, কই মাসিমা তো ওর সাথে আগে আমার পরিচয় করিয়ে দেন নি৷
প্রায় মিনিট দশেক অপেক্ষার পর আল্পনাদেবী একাই এলেন ৷ বললেন, ‘প্রদীপ তুমি কখন এলে ? তোমাকে কে ঘর খুলে দিল?’
প্রদীপ-বাবু হতবিহবল ৷ বললেন, ‘ছেলেটা’!
কার কথা বলছ ?
প্রদীপ-বাবু সবকথা খুলে বললেন ৷ বলতে বলতে কারেন্ট এসে হাজির ৷ ভিতরের ঘরে ঢুকে আল্পনাদেবীর চক্ষু ছানা-বড়া ৷ আলমিরা খোলা ৷ কাপড়-চোপড় ঘরের মধ্যে ছড়ানো ৷ আল্পনাদেবীর অলঙ্কারগুলি একটি পুটলিতে বাঁধা ৷ নিশি-কুটুম্বের আক্রমণ ৷প্রদীপবাবু এসে পড়ায় রক্ষা ৷ তবে একটি রূপার হার খোয়া গেছে ৷
কিন্তু প্রদীপ-বাবুর বিশ্বাস হচ্ছিল না ৷ তিনি তখনও কিছুটা হতবিহবল ৷ এমন ফুট-ফুটে ছেলেটা চোর ৷ প্রদীপ-বাবুর মন মানছিল না ৷ আমাদের কাছেও বিস্ময় গোপন রাখলেন না ৷ আল্পনাদেবী বললেন পাড়ার একটি ছেলের উপর আমার সন্দেহ হচ্ছে ৷ আমাদের ঠিক পরের গলিতেই বাড়ি ছিল ৷ ছেলেটি কলকাতার নরেন্দ্রপুর রামকৃষ্ণ মিশন স্কুলে পড়ত ৷ ক্লাস এইট পর্যন্ত পড়েই ফিরে আসে ৷ বাবা হঠাৎ মারা গেলেন ৷ ভদ্রলোক একটি বেসরকারি দপ্তরে চাকুরী করতেন ৷ একমাত্র ছেলে ৷ ভদ্রমহিলা কিছু পেনসন, গ্র্যাচুইটি পেলেন ৷ কলকাতা থেকে ফিরিয়ে এনে ছেলেকে বড়দোয়ালি স্কুলে ভর্তি করালেন ৷ প্রথম কিছুদিন বাড়ি-ঘরে ঝি-গিরি করে সংসার চালাতেন ৷ অথচ ছেলেটির জেঠুরা খুবই ধনী ৷ পরিবারটির প্রতি কোন সাহায্য করলেন না ৷ বছর ঘুরতেই উদ্ভিন্ন-যৌবনা বিধবা মহিলা বিয়ে করলেন ৷ নতুন বাবাকে ছেলেটি মেনে নিতে পারল না ৷ কুসঙ্গে পড়ল ৷ভদ্রমহিলা বাড়ি বিক্রি করে অন্যত্র ঘর বাঁধলেন ৷’
আল্পনাদেবী একটু থামলেন ৷ আমরা তন্ময় হয়ে শুনছিলাম ৷ আল্পনাদেবী আবার বলতে যাচ্ছিলেন ৷ করমচাঁদ বললেন, ‘আমি কইয়াম ৷’
বলেই নিজের খাতা খুললেন ৷ কয়েকটি পাতা উল্টে একটি পাতায় এসে থামলেন, ‘ছেলেটির নাম কি প্রকাশ চৌধুরী ? পিতা স্বর্গীয় পবন চৌধুরী ৷ বাড়ি শ্রীনগর মিলনচক্র, অরুন্ধতীনগর ৷’
এবার আল্পনাদেবীর অবাক হবার পালা ৷ ভদ্রমহিলার চোখে-মুখে করমচাঁদের প্রতি শ্রদ্ধা উছলে পড়ল ৷ আল্পনাদেবীর সম্মতিসূচক ইশারার পর করমচাঁদ শুরু করলেন, ‘আমি প্রকাশ্যারে ধইরাম ৷ রাত্রিতে আই.জি.এম. হাসপাতালের গাছতলায় ঘুমায় ৷ দিনের বেলা একটা সাইকেল লইয়া আগরতলা শহরটা চোঁ চোঁ কইরা ঘুইরায় ৷ চুরির খাতায় নতুন নাম লিখাইছে ৷ ফর্টিওয়ানে দু-একবার চালান গেছে৷’
একটু থেমে করমচাঁদ বললেন, ‘ম্যাডাম যদি অনুমতি দেন তবে একটা গল্প বলি৷’
আমি বললাম, ‘প্রত্যুষ-বাবু, কই আপনার পি.আই.বি.-তে প্রকাশের খবর প্রকাশ হয় নি ?’
বলে আমি আল্পনাদেবীদের প্রত্যুষ ইনফরমেশন ব্যুরো বা পি.আই.বি.-র ব্যাখ্যা দিলাম ৷ সবাই একপ্রস্ত হাসলাম ৷ কিন্তু করমচাঁদ গম্ভীরভাবে বললেন, ‘একখান কথা আছে ৷ সংসার সুখের হয় রমণীর গুনে ৷ প্রকাশ্যাতো বাইচ্চা আছে ৷ এর মত একটা ভালো পুলা আগরতলা শহরে মারা গেইছল ৷ আমরা চাকুরীতে যোগ-দেয়া অবধি শুনছি ৷ তখন ত্রিপুরা বোর্ড হয় নাই ৷ ওয়েস্ট বেঙ্গল বোর্ডের আন্ডারে পরীক্ষা হইত ৷ এখনতো ফাস্ট ডিভিশন, লেটারের রমরমা ৷ তখনকার দিনে হাতে গুইন্যা কয়েকটা ফাস্ট ডিভিশন আইত ৷ তবে তখনো আগরতলার নেতাজী, বোধজং, উমাকান্ত, ধর্মনগরের বি.বি.আই., উদয়পুরের রমেশ ভালো ফল করত ৷ ছেলেটা আগরতলার একটা স্কুল থাইক্যা পরীক্ষা দিছিল ৷ ওয়েস্ট বেঙ্গল বোর্ডে সেকেন্ড হইছিল ৷ তারপর দিল্লী আই.আই.টি-তে ভর্তি হইল ৷ বাপডাও বড় চাকুরী করত ৷ মাও দেখতে অতীব সুন্দরী ৷ একটাই ছেলে ৷ এক বছরের মাথায় বাপডা অ্যাকসিডেন্টে না কেমনে যেন মারা গেল ৷ বাপের কাজ সাইরা পোলা গেল আবার কলেজও ৷ এ ধরনের পোলাপান বাড়ি-ঘরের খবর রাখে না ৷ এরা আরেক কিসিমের মানুষ ৷ ছেলেডার সাথে পড়ত আরেকটি ছেলে ৷ হের বন্ধু ৷ বাবা আর্মির অফিসার ৷ জব্বলপুর না কই যেন বাড়ি ৷ হিডা একদিন কইল কাকার বিয়া ৷ বাড়ি যাইব ৷বিয়া আসলে হইয়া গেছে ৷ কাকা বি.এস.এফ.-এ চাকুরী করে ৷
কাকাও অফিসার ৷ ত্রিপুরায় পোস্টিং ৷ ত্রিপুরার মাইয়া বিয়া কইরছে শুইন্যা বন্ধুর কাছ থেকে ছবি নিয়া দেখল ৷ দেখে কিতা হের মার ছবি ৷ বিয়ার কার্ডেও মার নাম লিখা আছে ৷ হেইদিনঅই ছেলেডা সুইসাইড করল ৷ হেই বডি আর ত্রিপুরায় আইল না ৷’
করমচাঁদের ভাব দেখে মনে হল সেদিনই কেইস নিয়ে তদন্ত শুরু করেন ৷ আমি তাকে বললাম প্রকাশকে ধরার ব্যবস্থা করুন ৷ সেদিন রাত্রেই করমচাঁদ প্রকাশকে পাকরাও করলেন ৷ আই.জি.মের চত্বর থেকে ৷ ওর গলায় আল্পনাদেবীর হারটি ঝুলছিল ৷ আল্পনাদেবী কোন মামলা দিলেন না ৷ হারটিও দাবি করলেন না ৷ তারপর প্রকাশ অনেকবার ধরা পড়েছে ৷ চুরি ডাকাতির কেসে ৷ জেলও খেটেছে ৷ কিন্তু কখনো তার কাছ থেকে বামাল উদ্ধার করতে পারিনি ৷ শেষ খবর প্রকাশ শিলচর চলে গেছে ৷ নতুন পরিচয়ে সংসার পেতেছে ৷ জনারণ্যে মিশে নূতন আঙ্গিকে হয়তো নিজেকে প্রকাশ করতে পেরেছে ৷ কিন্তু করমচাঁদের ডায়রি পড়ে আমি ভাবছিলাম ‘আরেক কিসিমের’ ছেলেটির কথা ৷ একটি পঙক্তি মনে এলো :
‘ রাতের সব তারাই আছে
দিনের আলোর গভীরে ৷’
রোদ্দুরের গভীরে প্রবেশ দরকার ৷ আমি একটি ভালো দূরবীনের সন্ধানে আছি৷
উপরের এই অংশটুকু করমচাঁদের ডায়রি থেকে ধার করা ৷ প্রকাশ বাংলাদেশে আছে আমার ধারনা ছিল না ৷ জুন, ২০১৫ সাল ৷ সরকারী কাজে বাংলাদেশ গিয়েছি ৷ দিন কয়েকের জন্য ৷ একটি দলের সাথে ৷ সুযোগ এসেছে পূব থেকে পশ্চিম বাংলাদেশের বুক চিরে বেরিয়ে যাওয়ার ৷ বাংলাদেশীদের আতিথেয়তা সর্বজনবিদিত ৷ আই.এস.ও. কিংবা যেকোনো মাপকাঠিতেই সেরা ৷ তাই তার বর্ণনায় যাচ্ছি না ৷ তখন সকাল ৷ আখাউড়া থেকে ঘণ্টা-দেড়েক চলার পর আমরা থামলাম কিশোরগঞ্জে ৷ আগে ছিল ময়মনসিংহের অংশ ৷ এখন পৃথক জিলা ৷ একজন কর্মকর্তা জানালেন নীরদ চন্দ্র চৌধুরীর জন্মস্থান ৷ এখান থেকে একটি রাস্তা চলে গেছে সিলেটের দিকে ৷ আমি তাই একমনে ভাবছিলাম সিলেটের কৃতি সন্তান শ্রী-গৌরাঙ্গ, শাহজালাল, হাসুন রাজাদের কথা ৷ তাঁদের ভাবের কথা ৷ তাঁদের দর্শনের কথা ৷যন্ত্রের মত চলছিলাম দলের পিছু পিছু রেস্টুরেন্টে ৷ সুন্দর ভোজনালয় ৷ বয়রা বেশ কেতা-দূরস্থ ৷ একই রকম পোষাকে সজ্জিত ৷ চা-নাস্তা সবার আগেই সারলাম ৷ ভাবলাম, বেরিয়ে এসে চার-পাশটা ভালো করে দেখব ৷ বেরুবার মুখে একটি বয় বলল, ‘স্যার সেলাম ওয়ালি-কুম, ভালো আছেন ?’
চেহারা দেখে একটু খটকা লাগল ৷ বললাম, ‘তোমার নাম কি?’
প্রকাশ চৌধুরী ৷চৌধুরী উপাধি হিন্দু এবং মুসলমান দুই অংশের লোকই ব্যবহার করে ৷ তাই মনে কিছু খটকা রয়েই গেল ৷ কিন্তু এর পর থেকে একবারের জন্যও প্রকাশের কথা ভুলতে পারছিলাম না ৷ কুশিনারাকে নিয়ে একটি কাহিনী পড়েছিলাম৷ নালন্দা থেকে পাটলিপুত্র-বৈশালী হয়ে কপিলাবস্তু যাবার পথে কুশিনারা৷ বুদ্ধদেব এখানে দেহ রাখেন ৷ কথিত আছে তখন অকালে শাল-বৃক্ষে ফুল এসেছিল ৷ কুশিনারা বর্তমান উত্তর প্রদেশে অবস্থিত ৷ অনেক বৌদ্ধ-ধর্মাবলম্বী জাপানি মেয়েরা এখানে আসে ৷ তরা বিশ্বাস করে এখানকার ছেলেদের শরীরে মিশে আছে তথাগতের রক্ত ৷ তাই অনেক সময়ই তারা স্থানীয় গাইডদের বিয়ে করে সংসার পাতে ৷ আমার দৃঢ় বিশ্বাস প্রকাশ সিলেটের কোন মেয়েকে বিয়ে করেছে ৷ আর তাই সে স্বাভাবিক জীবনে ফিরে এসেছে ৷
আমি বাংলাদেশের প্রতিনিধিকে জিজ্ঞেস করলাম প্রকাশের মত বয়েরা কত বেতন পায় ৷ উত্তর এলো বাংলাদেশী টাকায় মাসিক দু-হাজার টাকা ৷ এর অতিরিক্ত, অনেক সময় কিছু টিপস পায় ৷ প্রায় একই রকম বেতন পায় ভিলেজ গার্ডেরা ৷ বাংলাদেশের সরকারি কিংবা বেসরকারি দুইটি ক্ষেত্রেই বেতন-ভাতা আমাদের তুলনায় অনেক কম ৷ কিন্তু লোকজন কর্মঠ ৷ পেট-মোটা লোক খুব কমই নজরে আসে ৷ তবে একটি শ্রেণী আছে খুবই ধনী ৷ বিলাসবহুল গাড়ি-বাড়ির মালিক ৷ মনে হল তারাই সমাজের নীতি-নির্ধারক ৷ যদিও এই বৈষম্য আমাদের ভারতবর্ষেও আছে ৷ কিন্তু তফাৎটা চোখে পড়ার মত ৷
কয়েকটি জিনিস ভালো লাগল ৷ ভারতীয়দের প্রতি বাংলাদেশী জনগণের আন্তরিকতা ৷ ভারত-বাংলাদেশ-নেপাল-ভুটান নিয়ে বাণিজ্যিক ক্ষেত্র গড়ার স্বপ্ন ৷ বনায়নের প্রতি যত্ন ৷ আগরতলা থেকে কলিকাতার দূরত্ব ৫১৩ কিলোমিটার ৷ এর মধ্যে আছে বেনাপোল-পেট্রপোল থেকে কলিকাতা পর্যন্ত ৮৪ কিলোমিটার দূরত্ব ৷ দু`পাশে সাড়ি দিয়ে আম,জাম,কাঁঠাল ইত্যাদি ফল-পসারির গাছ ৷ অনেক জায়গায় রাস্তা থেকে অনেকটা দূর অবধি ৷ তারপর দিগন্ত বিস্তৃত মাঠ ৷ রাস্তা খুবই ভালো ৷ শুধুমাত্র আখাউড়া থেকে ব্রাহ্মণবাড়িয়া অবধি রাস্তা অল্প সরু ৷ মধ্যে পদ্মা পারাপরের জন্য ঘণ্টা খানেক সময় লাগে ৷ আমি শচীন কর্তার ‘পদ্মার ঢেউ’ দেখতে পাইনি ৷ পদ্মা আমার কাছে স্নিগ্ধ রূপে এসেছে ৷ আমার কাছে উজাড় করে দিয়েছে তার জ্যোৎস্না রাতের মাধুর্য ৷ এইটুকু বাদ দিলে বাংলাদেশের বুক-চিরে পূবে-পশ্চিমে ভ্রমণ অন্ত-বিহীন মনে হয় ৷ এই সফর পূর্ণ করতে কেন প্রায় পুরো দিন লেগে যায় সেটা আমার কাছে বিশাল গোলক ধাঁধা ৷
ফিরতি পথে আবার গেলাম কিশোরগঞ্জের সেই রেস্তোরায় ৷ এবার রাত্রিতে ৷ আবার প্রকাশের সাথে দেখা ৷ ঢুকার মুখেই ৷ সে বলল, ‘স্যার সেলাম ওয়ালি-কুম, ভালো আছেন ?’
আমি অভিবাদন গ্রহণ করলাম ৷ ভাবলাম ওকে কিছু টিপস দেব ৷ ওর পরিবার সম্পর্কে জানব ৷ কিন্তু সেই মুহূর্তে প্রাকৃতিক ডাকের তাড়া ছিল ৷ টয়লেট সেরে এসে দেখি প্রকাশ হাওয়া ৷ অন্য বয়েরাও প্রকাশ কোথায় গেছে সদুত্তর দিতে পারল না ৷ আবারও একবার রবিঠাকুরকে স্মরণ করলাম:
‘ রাতের সব তারাই আছে
দিনের আলোর গভীরে ৷’
পঙক্তিটি তাঁর ‘হঠাৎ দেখা’ কবিতা থেকে নেওয়া ৷ কবি সে-যাত্রা তাঁর প্রেমিকাকে রেল গাড়ির কামরায় অল্পক্ষণের জন্য পেয়েছিলেন ৷ আর এই অন্তবিহীন পথে প্রকাশকে আমি দুবারের জন্য পেলাম ৷ আমি কবির চেয়ে ভাগ্যবান ৷
লেখকঃ ভারতীয় পুলিশের উচ্চপদস্থ কর্মকর্তা ও জনপ্রিয় সাহিত্যিক
আর্টিকেলটি নিয়ে মন্তব্য করুন