অনুপ কুমার মালাকার, ফ্রিল্যাঞ্চার
আউটসোর্সিং এখন আর বাংলাদেশে অপিরিচিত কোন শব্দ নয়। কম বেশি সবাই এই শব্দটির ব্যাপারে অবগত। বিশেষ করে আমাদের তরুন সমাজের এই জগতের প্রতি প্রবল আকর্ষন রয়েছে। আউটসোর্সিং কিংবা ফ্রীল্যান্সিং যে নামেই ডাকা হোক না কেন এর মূল লক্ষ্য হল বাঁধাধরা নিয়মের বাইরে গিয়ে নিজের খুশিমতো সময়ে চুক্তির মাধ্যমে পাওয়া কাজটি সম্পন্ন করে বুঝিয়ে দেয়া ও বিনিময়ে একটি নির্দিষ্ট পরিমান অর্থ পারিশ্রমিক হিসেবে পাওয়া। শুনতে বেশ ভালই লাগে! এই কারণেই মূলত তরুণ শিক্ষার্থী সমাজে এক জাদুর বাঁশির নাম এই ফ্রীল্যান্সিং বা আউটসোর্সিং। সত্যিই কি জাদুর বাঁশি এই ব্যাপারটি? সত্যিই কি স্বল্প পরিশ্রমে সাবলীল হয়ে সম্মানজনক অর্থ উপার্জন করা যায় আউটসোর্সিং করে? আসলে কি এই আউটসোর্সিং?
প্রথম কথা হল আউটসোর্সিং ভীনগ্রহী কোন শব্দ নয়। শুনতে নতুন মনে হলেও আউটসোর্সিং এর মৌলিক ধারণা নতুন কিছু নয়। সহজ কথায় কোনধনী দেশ, প্রতিষ্ঠান বা ব্যক্তি যখন টাকা বাঁচাতে স্বল্প পারিশ্রমিকে ভীনদেশী বা নিজের দেশেরই কোন প্রতিষ্ঠান,ব্যক্তি বা কারখানার সাহায্য নিয়ে কোন কাজ করিয়ে নেয় তখন তা আউটসোর্সিং নামে পরিচিত হয়। যেমন আমেরিকা তাদের দেশের অধিকাংশ ফুড প্রসেসিং এর কাজ চীন থেকে করায় কেননা চীনে শ্রমবাজার ও প্রযুক্তির দাম আমেরিকার থেকে অনেক সস্তা। আবার বলা যায় বাংলাদেশের গার্মেন্টস সেক্টরের আয়ও কিন্তু আউটসোর্সিং এর আয়। কেননা বাংলাদেশে সস্তায় শ্রমিক পাওয়া যায় এবং বিদেশী মার্চেন্টরা বাংলাদেশে এসে তাদের পোশাকের উৎপাদনের কাজটি করিয়ে নিয়ে অনেকটা অর্থ সাশ্রয় করতে পারে। কাজেই আউটসোর্সিং কোন আলাদিনের প্রদীপ নয় যে ঘষা দিলেই ডলার কিংবা টাকা বেরিয়ে আসবে। চীন কিংবা বাংলাদেশ যদি খারাপ মানের পণ্য ডেলিভারি দেয় তাহলে মূল প্রতিষ্ঠান আর কখনোই দ্বিতীয় বার অর্ডার করবে না। কাজেই পরিশ্রম আমেরিকায় থেকেও যেটুকু করতে হবে বাংলাদেশে বা চীনে থেকেও তার সমপরিমান করতে হবে। পার্থক্য এইটুকুই যে পারিশ্রমিক আন্তর্জাতিক মানদন্ডে পাওয়া যাবে অর্থাৎ ডলারের মূল্য বেশি হওয়ায় কিছুটা কম পরিমান পারিশ্রমিক ডলার হিসাবে পেলেও বাংলাদেশী টাকায় তা বেশ মোটা অংকেই গিয়ে দাঁড়াবে। এই হল আসল কথা। বাকী যা শোনা যায় যেমন, ঘরে বসে কোটিপতি, লাখপতি কিংবা ১৫ দিনে কোর্স করে হাজার ডলার কামান -সবই নির্জলা শুভঙ্করের ফাঁকি!
একুশ শতকে আউটসোর্সিং একটি নতুন রূপ পেয়েছে। যোগাযোগের এক জাদুকরী মাধ্যম হিসেবে আমরা পেয়েছি ইন্টারনেট। শুরুতে শুধু উচ্চবিত্তদের ব্যবহার্য হলেও ব্রডব্যান্ড ইন্টারনেট এখন গণমানুষের যোগাযোগের মাধ্যম। পুরো পৃথিবীই যেন আমাদের কম্পিউটারের চারকোনা মনিটরে ধরা দিয়েছে। চোখের পলকে পৃথিবীর এক প্রান্তের সাথে আরেক প্রান্তের মানুষ যোগাযোগ করতে পারছে। এই সুযোগের অনন্য ব্যবহার ঘটেছে আউটসোর্সিং জগতে। পূর্বে সাধারণ নাগরিকদের দেশের বাইরে যোগাযোগ সহজ ছিল না। কিন্তু ইন্টারনেট সেই সুযোগটি আমাদের হাতের মুঠোয় নিয়ে এসেছে। তৈরী হয়েছে ইন্টারনেট ভিত্তিক শ্রমবাজার যা কাগজে কলমে মার্কেটপ্লেস নামে পরিচিত।
বাংলাদেশের মানুষ আউটসোর্সিং শব্দটির সাথে ব্যপকভাবে পরিচিত হয় ডোল্যান্সার নামক ওয়েবসাইটের মাধ্যমে। যেখানে মূলত এডভার্টাইজ দেখে ও ক্লিক করে টাকা পাওয়া যেত! শোনা যায় অনেকে এই ওয়েবসাইটের অর্থ দিয়ে ততকালীন সময়ে গাড়ীও কিনেছিল। সময়টা তখন ২০০৫-২০০৮ সাল। এরপর সময় বদলেছে। এই সমস্ত নামকাওয়াস্তে হঠকারী ওয়েবসাইট ও তাদের কর্মকান্ড শেষ হয়েছে। তবে তার আগে প্রতারিত হয়েছে কয়েক হাজার তরুণ। তারপর থেকে আমাদের সমাজে আউটসোর্সিং কিছুটা ট্যাবু আকারেই ছিল বেশ কিছু বছর এবং সেই নেতিবাচক প্রভাব এখনো কিছুটা রয়ে গেছে বলা যায়।
বিনা পরিশ্রমে অর্থ উপার্জনের চিন্তা কেবলি বোকামি। আর শুধু পরিশ্রম নয়, তার সাথে দরকার মেধা ও দক্ষতার প্রয়োগ। মাউসের কয়েকটি ক্লিকে টাকা উপার্জনের চেষ্টা মূর্খের স্বর্গে বাস করার সামিল। এই রাস্তা বন্ধ হয়ে গেছে অনেক আগেই। কাজেই এই আউটসোর্সিং করতে গেলে অন্যান্য পেশার মতই মেধা, দক্ষতা এবং অবশ্যই একান্ত অনুশীলনের প্রয়োজন। এই জিনিসটিই আমাদের স্বপ্নে বিভোর তরুণ সমাজ বুঝতে দেরী করে। সহজে অর্থ উপার্জনেত আশায় তারা ভুল রাস্তা অনুসরণ করে মূল্যবান সময় ও শ্রম অপাত্রে ঢেলে দেয়।
অনলাইনে কি কাজ পাওয়া যায়?
ব্যক্তিগত উদ্যোগে অনলাইন বা ইন্টারনেট মার্কেটপ্লেসে যেসব কাজ পাওয়া যায় তা সাধারন চাকরীতে করা কাজ থেকে ভিন্ন হতে পারে আবার একই রকম হতে পারে। এক্ষেত্রে শুধু কাজ ও যোগাযোগেরর মাধ্যম হিসেবে ব্যবহার হয় ইন্টারনেট। ইন্টারনেট মার্কেটপ্লেসে জনপ্রিয় কিছু কাজের মধ্যে অন্যতম হলঃ
১.ওয়েব ডিজাইন এন্ড ডেভেলপিং
২.ওয়ার্ডপ্রেস,জুমলা ইত্যাদি জনপ্রিয় সিএমএস ডেভেএলপিং কাজ
৩.ওয়েব সার্ভার মেইন্টেনেন্স সংক্রান্ত কাজ
৪.এন্ডয়েড ও আইএসও এপ ডেভেলপিং
৫.গ্রাফিক্স ডিজাইন, লোগো ডিজাইন
৬.ত্রিডি রেন্ডারিং ও আর্কিটেক্টচারাল ডিজাইন সম্পর্কিত কাজ।
৭.ভিএফএক্স
৮.ওয়েব রিসার্স ও ওয়েব এসিসটিং
৯.আর্টিকেল রাইটিং
১০.ট্রান্সলেটিং
এর বাইরে টেলিকমিউনিকেশন কিংবা কাস্টম সফটওয়্যার ক্রিয়েশন মূলক অনেকরকম কাজ আউটসোর্সিং এর মাধ্যমে করা হয়, তবে এসব কাজ ফুলটাইম প্রফেশনাল ও ওয়েবফার্মের মাধ্যমেই করা হয়, ব্যক্তিগত উদ্যোগে এসব কাজ পাওয়া কিংবা করে ওঠা খুবই কঠিন। এছাড়া ব্লগিং ও এফিলিয়েট মার্কেটিংয়েও সফলতা পাওয়া যায় কিন্তু পার্ট হিসেবে নিলে আমার মনে হয় সফল হওয়া প্রায় অসম্ভব।
অনলাইনে কাজ পাওয়ার ক্ষেত্রে জনপ্রিয় কয়েকটি মার্কেটপ্লেস হলঃ
১.Upwork.com(পূর্বে odesk.com নামে পরিচিত ছিল)
2.Freelancer.com
3.Guru.com
4.fiverr.com
এসব মার্কেটপ্লেসে বায়ার ও ওয়ার্কারা একত্রিত হন তাদের প্রয়োজনীয় কাজটি করে ও করিয়ে নিতে। কাজের বিনিময়ে অর্থ উপার্জন করে ওয়ার্কার ও তাদের পেমেন্ট দেয় বায়ার। ভালো কাজ করলে একই বায়ারের কাজ থেকে দীর্ঘদিন কাজ পাওয়া যায়, এতে রেপুটেশন ও উপার্জন দুইই আস্তে আস্তে বাড়ে। এবার আসল কথায় আসা যাক। প্রশ্ন হচ্ছে ফ্রিল্যান্সিং কি আসলেই পার্টটাইম পেশা হিসেবে নেওয়া যায় কিনা?
একটা উদাহরন দেয়া যাক,ধরুন আপনি পার্টটাইম টিউশানি করান, এখন আপনি যদি অংকের শিক্ষক হন, নিশ্চয় আপনাকে ওই ক্লাসের গণিত বই সম্পর্কে স্বছ্ব ধারণা থাকতে হবে। অথবা আপনি পার্টটাইম কোন কলসেন্টারে চাকরী করেন, হয়ত সময় আপনি কম দেন, কিন্তু তার মানে এই না আপনাকে পুরোপুরি কাজের উপযোগী না করে অফিস আপনাকে ডিউটিতে জয়েন করাবে। অর্থাৎ চাকরী পার্ট টাইম বা ফুল টাইম হোক সঠিক দক্ষতা থাকা বাঞ্ছনীয়। আউটসোর্সিং এর ক্ষেত্রেও তাই, রাতারাতি ঝাঁপিয়ে পড়লে এই জগত থেকে কানাকড়িও উপার্জন সম্ভব নয়। বরং আউটসোর্সিং থেকে টাকা উপার্জনে দক্ষতা, প্রশিক্ষন ও অনুশীলন আরো বেশী জরুরী, কেননা প্রতিটি মার্কেটিংপ্লেসই এখন প্রতিযোগিতায় ঠাসা।
পড়াশুনার পাশাপাশি আউটসোর্সিং যে একেবারে অসম্ভব তা বলতে চাই না। তবে বলতেই হবে কঠিন কাজ। আর যদি একেবারেই জানাশুনা না থাকে তাহলে তো আরো কঠিন। সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ জিনিস যেটি দরকার সেটি হল প্যাশন, কাজটির প্রতি ভালবাসা আর অগাধ ধৈর্য। এছাড়া এ ফিল্ড থেকে কাঙ্ক্ষিত সাফল্য পাওয়া সম্ভব নয়।
আমার ফ্রিল্যান্সার হয়ে ওঠা
আউটসোর্সিং জগতের সাথে আমার পরিচয় ইন্টারমিডিয়েট পড়ার শেষ করে ইউনিভারসিটি ভর্তি কোচিং করার সময়, তখন ২০১১ সাল। ওয়েব ডিজাইন, গ্রাফিক্স ডিজাইন, ওয়েব এসিসটিং অনেককিছুই ট্রাই করেছি। কানাকড়ি সফলতাও আসেনি। সাফল্য এল দীর্ঘ চার বছর পর ২০১৫ এর শেষের দিকে। ওয়েব মেইনটেনেন্স সংক্রান্ত বেশ কিছু কাজ পেলাম, যার কিছু কাজ এখনো চলছে। মাঝখানের চার বছরেরও বেশি সময় অগনিত ঘন্টা বিশ্ববিদ্যালয়ের লাইব্রেরীর সাইবার ক্যাফেতে দিয়েছি, নাওয়া খাওয়া প্রায় ছেড়ে দেবার অবস্থা হয়েছিল। হয়ত শেষ মূহুর্ত পর্যন্ত হাল ছাড়িনি বিধায় কিছুটা হলেও সাফল্যের দেখা পেয়েছি।
কোন কাজটি করবেন?
আগে নিজের কাছে প্রশ্ন করুন, অনলাইনে প্রচিলিত কাজগুলো সত্যিই আপনাকে আকর্ষণ করে কিনা। ভেবে দেখুন ঘন্টার পর ঘন্টা সময় দিতে পারবেন কিনা। সেই সাথে সবসময়ের জন্য ইন্টারনেট কানেকশন থাকাও জরুরি।
অনেকেই প্রাকৃতিক ভাবে আর্ট ও ড্রয়িং এর প্রতিভা নিয়ে জন্মে। সেই মেধা কাজে লাগিয়ে গ্রাফিক্স ডিজাইনের কাজ শুরু করা যায়। সেই সাথে রয়েছে ফটো এডিটিং, রিটাচিং, ব্যাকগ্রাউন্ড রিমুভিংসহ বিভিন্ন কাজ। সময়ের সাথে সাথে নতুন নতুন আইডিয়া নিয়ে কাজ করতে হবে। এজন্য Fiverr.com এর ট্রেন্ডিং টপিকগুলো ফলো করতে পারেন। নতুন নতুন কাজের ক্ষেত্র সম্পর্কে ধারণা পাবেন।
প্রশিক্ষণ নিন, অনুশীলন করুন
হ্যাঁ, প্রকৃতই সফলতা পেতে চাইলে প্রশিক্ষণ নিতে বা কোর্স করতে পারেন। Creative IT ও Devsteam এ বিভিন্ন প্রফেশনাল কোর্স রয়েছে যা আপনাকে স্বল্প সময়ে দক্ষ করতে সাহায্য করতে পারে। তবে আগে আয়ের কথা ভুলে গিয়ে কাজটা মনোযোগ দিয়ে শিখতে হবে। দক্ষতা অর্জনের পরেই আয়ের জন্য মাঠে নামা ভাল। নাহলে শুধু শুধু সময় ও শ্রমের অপচয় হবে।
অনলাইনে উপার্জিত অর্থ কিভাবে তুলবেন?
অনেকে অনলাইনে আয় করা অর্থ উত্তোলন নিয়ে বিচলিত হয়ে পড়েন। কথা হল, আয় হলে তা উত্তোলনের একটা ব্যবস্থা হবেই। সে ধাপ পর্যন্ত না পৌঁছানো পর্যন্ত এ নিয়ে মাথা না ঘামানোই ভাল। পেওনিয়ার বর্তমানে অনলাইনে অর্থ উত্তোলনের জনপ্রিয় মাধ্যম। তবে অনলাইনে আয়ের উৎস না থাকলে এই কার্ডটি সম্পুর্ন মূল্যহীন। পেওনিয়ার, ব্যাংক ট্রান্সফার, পেয়জা ইত্যাদি বিভিন্ন মাধ্যমে সহজেই টাকা উত্তোলন করা যাবে। তবে যা আগেই বলেছি,আগে কাজ তারপর এসব নিয়ে ভাবনা।
বিশ্বে অনলাইন আউটসোর্সিং এর বাজার কয়েকশ বিলিয়ন ডলারের। প্রতিদিনই নতুন নতুন কাজের পথ তৈরী হচ্ছে, নতুন নতুন মানুষ যুক্ত হচ্ছে। এর মধ্যে থেকেই নিজের অবস্থান তৈরী করে নিতে হবে।
আউটসোর্সিং আর পাঁচটা পার্টটাইম কাজের মত না, যে শুরু করে দিলেই মাস শেষে কিছু টাকা স্যালারী হিসেবে পাওয়া যাবে। এখানে প্যাশনের মূল্য অনেক বেশী। বাংলাদেশে এখন অনেকেই রয়েছেন যারা এই কাজগুলোর প্রতি ভালোবাসা থেকে এখন একে ফুল টাইম প্রফেশন হিসেবে বেছে নিয়েছেন। তাদের অনেকের মাসিক ইনকাম সত্যিকার অর্থেই মাথা ঘুরিয়ে দেবার মত। যেহেতু আমার লেখাটি শিক্ষার্থীদের কথা মাথায় রেখে লিখছি, তাই বলব পার্টটাইম হিসেবে আউটসোর্সিং আপনাকে কঠিন চ্যালেঞ্জেরর মুখে ফেলতে পারে। তবে সে বাঁধা অতিক্রম করে যদি সফলতার মুখ দেখতে পান তাহলে কে বলতে পারে, সারাজীবন ঘরে বসে ইনকামের রাস্তার সন্ধান পেয়ে যাবেন!
লেখকঃ স্নাতকোত্তর শিক্ষার্থী, সাংবাদিকতা ও গণমাধ্যম অধ্যয়ন বিভাগ, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়।
আর্টিকেলটি নিয়ে মন্তব্য করুন