পাকিস্তানে শ্রীলংকা ক্রিকেট দলের উপর সন্ত্রাসী হামলার ভয়াবহতা!

সন্ত্রাস মানুষের মনে আতঙ্ক ও ত্রাস সৃষ্টি করার এক নাম। সুস্থ স্বাভাবিকভাবে বেঁচে থাকার জন্য সন্ত্রাস কাম্য নয়। স্বাভাবিক জীবনযাত্রায় বাধা সৃষ্টিকারী যে সকল বিষয় রয়েছে তার মধ্য সন্ত্রাস একটি। একবিংশ শতাব্দীতে এসে অনেক রাষ্ট্র সন্ত্রাস বিরোধী কর্মকাণ্ড রোধে সোচ্চার হয়েছে। জীবনের কোনো ক্ষেত্রে সন্ত্রাসবাদ কাম্য নয় হোক তা রাষ্ট্রীয় ক্ষেত্রে, আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে, ফুটবল বা ক্রিকেট অঙ্গনে। ক্রিকেট অঙ্গনে খেলোয়াড়দের মধ্যে থাকে সৌহার্দ্যপূর্ণ আচারণ। একজন খেলোয়াড় আহত হলে বিপক্ষ দলের খেলোয়াড়রা এসে খোঁজ খবর নেয় গুরুতর আহত হয়েছে কিনা, এক ধরনের সদ্ভাব বজায় রেখে খেলতে হয়। ক্রিকেটে প্রতিযোগিতা থাকে সুস্থ প্রতিযোগিতা,এখানে কোনো সন্ত্রাস বা অন্যায় মূলক কাজের স্থান নেই। কিন্তু যদি ক্রিকেট অঙ্গনে হয় সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড তাহলে ক্রিকেট অঙ্গনে সেদিনকার অবস্থা কেমন ছিলো, তুলে ধরবো বিস্তারিত।

২০০৯ সাল ৩ মার্চ দিনটি ছিল মঙ্গলবার, সকালে লাহোর টেস্টের তৃতীয় দিনের প্রস্তুতি নিবে শ্রীলংকা ক্রিকেট দল। এজন্য তারা হোটেল থেকে বের হয়েছিল, লাহোরের গাদ্দাফি স্টেডিয়ামে যাওয়ার জন্য। কিন্তু পথের মধ্যে শ্রীলংকা ক্রিকেট দলকে বহনকারী বাসে হামলা চালায় সন্ত্রাসীরা। সন্ত্রাসীদের মূল লক্ষ্য ছিল শ্রীলংকান খেলোয়াড়দের হত্যা করা। শ্রীলংকান ক্রিকেটারদের বহনকারী বাসটির চালক ছিলেন খলিল। তিনি বলেন, হঠাৎ করে গোলাগুলি শুরু হয়। আমি বুঝতে পারি যে এটা ছিল সন্ত্রাসী হামলা। হামলার সঙ্গে সঙ্গে খেলোয়াড়রা বাসের মধ্যে শুয়ে পড়েছিল। এ সময় বাসটির পিছন থেকে সন্ত্রাসীরা রকেট লঞ্চার ব্যবহার করে গোলা ছুঁড়েছিল। কিন্তু তা অল্পের জন্য লক্ষ্যভ্রষ্ট হয়। এরপর একজন গ্রেনেডধারী বাসটির সামনে আসে গ্রেনেড ছোঁড়ার জন্য কিন্তু সে গ্রেনেড ছোঁড়ার আগে তার হাত থেকে গ্রেনেড পড়ে গিয়েছিল। এ সময় বাসটির ইঞ্জিন চালু ছিল তাই আমি বাসটি নিয়ে ঘটনাস্থল থেকে দ্রুত সর যেতে সক্ষম হয়েছিলাম। (সূএ: বিবিসি নিউজ)।

ফিলিস্তিনের জঙ্গি কর্তৃক ১৯৭২ সালে মিউনিখে অনুষ্ঠিত গ্রীষ্মকালীন অলিম্পিকে অংশগ্রহণকারী ইসরাইলি ক্রিড়াবিদদের হামলার পর এটাই প্রথম কোন জাতীয় দলের উপর সন্ত্রাসী আক্রমণ। পাকিস্তানের সাবেক ক্রিকেটার ইমরান খান বলেছিলেন, খেলোয়াড়দের পর্যাপ্ত নিরাপত্তা দেওয়া হয়নি। কিন্তু তৎকালীন পাকিস্তানের ক্রিকেট বোর্ডের প্রধান ইজাজ বাট তা আমলে না নিয়ে বলেছিলেন, খেলোয়াড়দের পর্যাপ্ত সুযোগ দেয়া হয়েছিল। এই হামলায় ৬ জন পুলিশ ও ২ জন পথচারী নিহত হয়েছিল। সন্ত্রাসীদের সাথে নিরাপত্তা বাহিনীর ২৫ মিনিট সংঘর্ষ হয়। শ্রীলংকা ক্রিকেট টিমের ৭ জন খেলোয়াড় হামলায় আহত হয়েছিল। এদের মধ্যে ফিলান সামারাবিরা ও পারানাভিতানাকে হাসপাতালে ভর্তি করা হয়েছিল। এছাড়া হামলায় পাকিস্তানি এক আম্পায়ার ও ম্যাচ রেফারি আহত হয়েছিল।

উক্ত সন্ত্রাসী হামলার তীব্র নিন্দা জানিয়েছিল বিভিন্ন দেশের ক্রিকেট বোর্ডগুলো। তৎকালীন আইসিসির চেয়ারম্যান ডেবিড মরগ্যান জানিয়েছিলেন এটা ক্রিকেটের জন্য ভয়াবহ সংবাদ। আমি মনে করি এটা খুবই দুঃখজনক।

উক্ত হামলার ফলে পাকিস্তানের ক্রিকেট অনেক ক্ষতির সম্মুখীন হয়। প্রথমত: এই হামলার ফলে হামলার মাত্র দু্ই বছর ২০১১ সালের বিশ্বকাপ অনুষ্ঠিত হবে, সেখানে পাকিস্তানকে আয়োজক দেশ হিসাবে ধরা হয়েছিল। কিন্তু হামলার কারণে পাকিস্তানকে আয়োজক দেশের তালিকা থেকে বাদ দেওয়া হয়। বিশ্বকাপ আয়োজনের কথা ছিল চারটি দেশের কিন্তু স্বাগতিকদের তালিকা থেকে বাদ পড়ে পাকিস্তানের নাম। আয়োজক কমিটির প্রধান কার্যালয় লাহোর থেকে সরিয়ে নেওয়া হয় মুম্বাইয়ে। পাকিস্তানে হতে যাওয়া ১৪টি ম্যাচ আটটি ভারতে, চারটি শ্রীলংকায়, দুটি বাংলাদেশে অনুষ্ঠিত হয়। ভারত ও শ্রীলংকা নিজেদের কন্ডিশনে ও নিজেদের পরিচিত পরিবেশকে কাজে লাগিয়ে দুইদল ওঠে ফাইনালে। এক্ষেত্রে পাকিস্তানের বড় রকম সম্ভাবনা থাকতো তাদেরও ফাইনালে ওঠার, যদি পাকিস্তান নিজেদের মাঠে খেলতে পারতো। পাকিস্তান নিজেদের ঘরে দ্বিতীয় বার শিরোপা তুলতে হয়তো পারতো। নিজেদের মাঠে বসে ক্রিকেট বিশ্বকাপ খেলা দেখা থেকে বঞ্চিত হয় পাকিস্তানের দর্শকমহল।

দ্বিতীয়ত: ২০০৯ সালে লাহরে শ্রীলংকা ক্রিকেট দলের বহনকারী বাসে হামলার পর পাকিস্তানে কোনো আন্তর্জাতিক ক্রিকেট ম্যাচ অনুষ্ঠিত হয়নি দীর্ঘ ১০ বছর ধরে। পাকিস্তানকে ক্রিকেট থেকে নির্বাসিত করা হয়। পাকিস্তানে দ্বিপাক্ষিক সিরিজ বা বহুজাতিক টুর্নামেন্ট অনুষ্ঠিত হয়নি। পাকিস্তান ক্রিকেট টিম যেহেতু হোম ভ্যানুতে খেলতে পারে নি, এজন্য তাদের ভিন্ন কন্ডিশনে গিয়ে খেলতে হয়েছে। অপরিচিত মাঠ ও পরিবেশে গিয়ে খেলা খুব কঠিন হয়ে পড়েছে। যে কারণে পাকিস্তানকে অনেক ম্যাচ হারতে হয়েছে। হোম ভেন্যুতে সব সময় নিজ দলগুলো আধিপত্য বিস্তার করে খেলতে পারে কারণ সব কিছু পরিচিত থাকে। এক্ষেত্রে পাকিস্তান আইসিসি র‍্যাকিং এ পিছিয়ে পড়ে।

তৃতীয়ত: দ্বি-পাক্ষিক সিরিজ বা বড় টুর্নামেন্টগুলোতে ক্রিকেট বোর্ডগুলো অনেক আর্থিক দিক দিয়ে লাভবান হতে পারে। দর্শক তাদের নিজেদের দেশে ক্রিকেট খেলা দেখার জন্য মুখিয়ে থাকে, এক্ষেত্রে পাকিস্তানের দর্শকমহল নিজেদের মাঠে খেলা দেখার সুযোগ থেকে বঞ্চিত হচ্ছে। পাকিস্তান ক্রিকেট বোর্ড বর্তমানে নানাভাবে চেষ্টা করছে কিভাবে পাকিস্তানে আবার আন্তর্জাতিক টুর্নামেন্ট ফিরিয়ে আনা যায়। ইতিমধ্যে পাকিস্তান কিছু দ্বিপাক্ষিক সিরিজ এবং বিশ্ব একাদশের সাথে ক্রিকেট ম্যাচ এর আয়োজন করছে।

চতুর্থত: পাকিস্তান ক্রিকেট বোর্ডকে এসিসি চলতি বছর ২০২০ এশিয়া কাপ টুর্নামেন্ট এর আযোজক দেশ হিসেবে ঘোষণা করে। কিন্তু চির প্রতিদ্বন্দ্বী ভারত শুরু থেকে এর বিরোধিতা করে আসছে। যদিও টুর্নামেন্টটি করোনাভাইরাস এর কারণে স্থগিত হয়েছে। ২০০৮ সালে সর্বশেষ এশিয়া কাপ টুর্নামেন্ট আয়োজন করে পাকিস্তান। এরপর এশিয়া কাপ টুর্নামেন্ট আয়োজন করা থেকে বঞ্চিত হয় পাকিস্তান।

অনেক সময় মন্দের মধ্য ভালো কিছু পাওয়া যায়। পাকিস্তানে ক্রিকেট নির্বাসিত হওয়ায় পাকিস্তান ভিন্ন কন্ডিশনে গিয়ে খেলতে হয়েছে বিগত দশ বছর ধরে। যে কারণে বিভিন্ন দেশের কন্ডিশন ও মাঠ সম্পর্কে অন্য দলগুলোর তুলনায় ভালো পারদর্শিতা অর্জন করছে পাকিস্তান। যার ফলে পাকিস্তান বর্তমানে নিজ কন্ডিশনের বাইরে ভালো করছে।


সাংবাদিকতা ও গণমাধ্যম অধ্যয়ন বিভাগ
৪৯তম আর্বতন, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *